Header Ads

Header ADS

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস

 স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস

অতীতকে বাদ দিয়ে বর্তমান বোঝা খুবই মশকিল, তাই বর্তমানকে বুঝতে হলে অতীতকে অবশ্যই বুঝতে হবে বর্তমানের বিশ্লেষণ ছাড়া ভবিষ্যতের পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায় না। স্বাধীন বাংলাদেশের অভুদুদয়ের ইতিহাস জানার পূর্বে আমরা একটু এই ভারতীয় উপমহাদেশের ইংরেজ শাসন থেকে অতি সংক্ষিপ্তভাবে কিছু জানার চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ।



১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামে যে নতুন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান লাভ করে তার ইতিহাস অনেক প্রাচীন এবং করুন।  এখানে আমরা সেই ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।  এবং আমরা শুরু করতে চাই ব্রিটিশ শাসনের সূচনা থেকেই। 


ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ রাজত্ব


স্বাধীন বাংলার সর্বশেষ নবাব হলেন নবাব সিরাজুদুল্লাহ মীরজাফরের ইংরেজদের সহযোগিতা এবং উমৎ লাভের কারণেই ১৮৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজত্বের সমাপ্তি ঘটে।  যে ব্যক্তি নিজের ক্ষমতার জন্য আপন দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল,  সঙ্গত কারণে ইংরেজরাও তাকে বিশ্বাস করতে পারল না।  এভাবেই মীর জাফরের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ইংরেজ রাজত্ব কায়েম করা হলো।  ১৮৫৭ সালে দিল্লির শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ইংরেজ রাজত্ব গোটা ভারত উপমহাদেশে মজবুত করা হলো। এভাবেই চলতে থাকলো ইংরেজিদের শাসন এবং পরাধীনতার শোষণ।


বাংলাদেশে ইংরেজিদের রাজত্ব


বাংলাদেশ থেকে ইংরেজি রাজত্ব শুরু হওয়ায় বাঙ্গালী মুসলমানেরা প্রায় ২০০ বছর ইংরেজীদের গোলামী করতে বাধ্য হয়।  এই সময়ে ইংরেজরা মুসলমানদের দমননীতির ফলে মুসলমানেরা দুই ধরনের গোলামির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।  এক তারা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দিক দিয়ে ইংরেজদের অধীনস্থ হয়ে পড়ল। অপরদিকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে মুসলিমদের প্রধানত হতে বাধ্য করা হলো।  যারা এক সময়ে মুসলমানদের প্রাধান্য মেনে চলত। তারা একসময় জমিদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হল। এই জমিদাররা মুসলমানদের অপর কি অত্যাচার করেছে তা একালের মুসলমানেরা ধারণা করতে অক্ষম।


ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা


১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার যখন কেন্দ্রীয় ও পরিষিক আইনসভা কায়েম করে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে স্থায়িত্ব শাসনের নামে আংশিক ক্ষমতা তুলে দেবার ব্যবস্থা করল,  তখন মুসলমানেরা পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা আদায় করে কিছুটা আত্মরক্ষার বন্দোবস্ত করল। মুসলিম জনগণের প্রতিনিধি যাতে শুধু মুসলিমদের ভোটে নির্বাচিত হতে পারে,  সে ব্যবস্থার নামই পৃথক নির্বাচন।  যুক্তনির্বাচন ব্যবস্থা মুসলিম ও অমুসলিমদের মিলিত ভোটে নির্বাচিত হলে কংগ্রেসের অমুসলিম নেতাদের মুরগি অনুযায়ী কিছুসংখ্যক মুসলিম আইনসভায় নির্বাচিত হলেও জাতি হিসেবে মুসলিমদের কোন পৃথক সত্তা থাকবে না আশঙ্কা করেই মুসলমানেরা পৃথক নির্বাচনের দাবি করেছিল। ১৯৪০ সালে মার্চ মাসে লাহুরে ঐতিহাসিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

আরো জানুন > সঠিক এলেম অর্জন করব কিভাবে

শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ওই সম্মেলনে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম সংখ্যাগুরু উপদেশগুলো নিয়ে ভারত থেকে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করেন,  যা সর্বসম্মতভাবেই গৃহীত হয়।  ওই প্রস্তাবটি ইতিহাসে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। সালটি ছিল ১৯৪৫ এই সময়ে ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভা ও ১৯৪৬ সালে প্রদেশিক আইনসভার সমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এখানে মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রস্তাবকেই নির্বাচনী ইস্যু বানায়।  সারা ভারতে মুসলিমগণ একটি পৃথক জাতি সত্তার মর্যাদা সহকারে ওই নির্বাচনে নিরংকুশ বিজয় লাভ করে। পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি না থাকলে কিছুতেই এই বিজয় অর্জন করা সম্ভব হতো না।  এই বিজয়ের ফলে বাধ্য হয়ে ইংরেজ সরকার পাকিস্তান দাবি মেনে নেয় এবং 1947 সালের আগস্ট মাসে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারত ও মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম হয়।


পাকিস্তান শাসন আমল


পাকিস্তানের অর্থ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।  এই স্লোগানই মুসলমানদের এই আন্দোলনের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে।  এমনকি ভারতের যে সাতটি প্রদেশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলে নির্ধারিত ছিল সেখানকার মুসলমানরাও ইসলামের আকর্ষণে পাকিস্তানিদের দাবিতে একনিষ্ঠভাবে সমর্থন যুগেিয়েছে।  এর পরিণামে লক্ষ লক্ষ মুসলমান শহীদ হয়েছে এবং জন্মভূমি ও সহায় সম্পদ থেকে বিতাড়িত হয়েছে।  ভারতে বসবাসকারী মুসলমানেরা তাদের অন্যায়ের কঠোর শাস্তি এখনো ভোগ করে চলেছে।


আইয়ুব খানের শাসনামল


আইয়ুব খান জাদরেল শাসক ছিলেন বটে কিন্তু মুসলিম লীগের নামেই তিনি রাজত্ব করেছেন।  অথচ তিনি তার শাসন আমলে মৌলিক গণতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্রই চালিয়ে গেছেন।


ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন


১৯৬৯ সালের শেষ দিকে প্রচন্ড ঘনা আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান ক্ষমতার ত্যাগ করে সেনাপতি ইয়াহিয়া খানকে সামরিক আইন জারি করার সুবর্ণ সুযোগ করে দেন আয়ুবের একনায়ক তত্ত্বের বিরুদ্ধে ১০ বছর ধরে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলছিল এর ফলে বিনা নির্বাচনে আর দেশ শাসন সম্ভব ছিল না।  তাই ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করলেন সমগ্র-অবিভক্ত পাকিস্তানি এটাই প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনের পর


আওয়ামী লীগের অবস্থা


পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনসভায় আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হওয়ায় শেখ মুজিবকে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী বলে মন্তব্য করা সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তরে ঘড়ি মসি করতে থাকে।  অপরদিকে ভুট্টো “এধার হাম” “ওধার তুম” বলে এক দেশে দুটি মেজরিটি পার্টির অদ্ভুত স্লোগান তুললেন।  বোঝা গেল যে ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের বাদশা হতে চান।  কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আলাদা না হলে সেই সুযোগ তার হয় না। তাই ইয়াহিয়া খানের সাথে যুগসাজ করে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে বাধা সৃষ্টি করতে লাগলেন।  তখন হয়তোবা ব্যালটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হলে আজকে এমন পরিণতি ভোগ করতে হতো না।


স্বাধীন বাংলাদেশের অবস্থা


আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ভারতে আশ্রয় নিলেন। সেই সাথে ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দলের বেশিরভাগ নেতাই ভারতে আশ্রয় নিলেন।  পাক সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে ও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য স্থানে হিন্দুবস্তুর ওপর আক্রমণ করলে তারাও দলে দলে ভারতে আশ্রয় নিলেন। পাক সেনাবাহিনীর ভ্রান্ত নীতির ফলে দেশের গোটা হিন্দু সম্প্রদায় পাকিস্তান বিরোধী হয়ে উঠল।  ধর্মনিরপেক্ষবাদী ও অধিকাংশ সমাজতান্ত্রিক দল পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার জন্য সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হল।


বাংলাদেশ স্বাধীনতার পেছনে ভারতের ভূমিকা


পাকিস্তানের ছিল দুশমন ভারতের সম্প্রসারণ বাজি কংগ্রেস সরকার ও মহাসচিব গ্রহণ করল।  প্রবাসী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত করা হলো। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা ট্রেনিং দেওয়া,  অস্ত্র ও গ্রেনেট দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠাবার ব্যবস্থা করা এবং সেই সাথে রেডিওযোগে প্রবাসী সরকারের বক্তব্য বাংলাদেশের ভেতরে প্রচার করা ইত্যাদি সবই ভারত সরকারের উদ্যোগ ও সহযোগিতা চলতে থাকলো। রুশ সরকার এ বিষয়ে ভারতের সাথে এক সহযোগিতা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।  ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং বহু দেশ সফর করে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন যোগানোর চেষ্টা করেন।  নিঃসন্দেহে সবই বাংলাদেশকে একটি  স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করতে সাহায্য করেছে,  তা বলার অপেক্ষা রাখে না।  কিন্তু ভারত সরকার তার স্বার্থে এ কাজে সহযোগিতা করেছে বলে সবাই স্বীকার করতে বাধ্য।


ভারত বিরোধীরা হতাশাগ্রস্ত


পাকিস্তান আন্দোলনের সময় থেকে যারা ভারতীয় কংগ্রেসের আচরণ লক্ষ্য করে এসেছে,  পাকিস্তান কায়েম হবার পর ভারতের নেহরু সরকার হায়দারাবাদ ও কাশ্মীরি নিয়ে যে হিংস্র খেলা দেখিয়েছেন,  মুসলমানদের পৃথক আভাস ভূমিকে পঙ্গু করার জন্য যত রকম প্রচেষ্টা ভারতের পক্ষ থেকে হয়েছে,  পূর্ব বাংলার সীমান্ত নিয়ে ভারত বারবার যে ধোঁকাবাজি করেছে,  সর্বোপরি ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে গঙ্গার পানি আটকে রেখে উত্তরবঙ্গকে মরুভূমি বানাবার যে ব্যবস্থা করা হয়েছে,  তাতে এ দেশের কোন সচেতন মানুষের পক্ষে ভারত সরকারকে এদেশের বন্ধু মনে করা কিছুতেই সম্ভব ছিল না।


বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পটভূমি


স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্বে যারা ছিলেন,  তারা সবাই পাকিস্তান আন্দোলনের বিশিষ্ট অবদান রেখেছেন।  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম,  জনাব তাইজুদ্দিনের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আন্দোলন পরিচালিত হয়। মুসলিম জাতীয়তার পতাকা বাহি হিসাবেই তারা ভারতীয় কংগ্রেসের ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন।  গান্ধী ও নেহেরুর নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ভিত্তিতে অখন্ড ভারতের একটি মাত্র রাষ্ট্র কায়েমের সংগ্রামী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দ্বিজাতীয় তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় পাকিস্তান কায়েমের আন্দোলনে তারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তখন তরুণ ছাত্রনেতা।  তারা মুসলিম লীগ নেতা শহীদপ্তর হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় ছিলেন।  এটা সবাই জানে। অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগে দুটি গ্রুপ ছিল।  এ গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জনাব শহীদ সরুয়ারদি ও জনাব আবুল হাশেম এবং অপর গ্রুপের নেতা ছিলেন মাওলানা আকরাম খান,  খাজা নাজিম উদ্দিন ও জনাব নুরুল আমিন।  বঙ্গদেশ বিভক্ত না হলে হয়তো সরোয়ারদী পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতেন।


পাকিস্তান সরকারের নীতি ছিল একটি ভ্রান্ত নীতি


পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ও কর্মবাহিনী সরকারি ও বিরোধী দলের বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম লীগ সরকার যদি ইসলামী আদর্শের প্রতি নিষ্ঠার পরিচয় দিতেন,  মুসলিম জাতীয়তাকে শুধু স্লোগান হিসেবে ব্যবহার না করতেন,  গণতান্ত্রিক নীতি মেনে চলতেন এবং অর্থনৈতিক ময়দানে ইনসাফের পরিচয় দিতেন,  তাহলে জাতিকে যে ধরনের মোকাবেলা করতে হয়েছে তা সৃষ্টি হতো না।


রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে পাকিস্তানের ভুল অবস্থান


পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার অধিকাংশই পূর্বভঙ্গের অধিবাসী হওয়া সত্বেও বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে অস্বীকার করা এবং বাংলা বাসীদের ওপর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার ভ্রান্ত নীতি সর্বপ্রথম বিবেদের বীজ বপন করে।  সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা বাসীরা বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষার দাবি তুলেন নি।  তারা উর্দু ও বাংলা উভয় ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন।  এ দাবি জানাবার আগেই জনসংখ্যার বিচারে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা সরকারের কর্তব্য ছিল।  তা না করে তারা ভুল পথে হাঁটতে থাকে।  যার ফলে বা ৫২ ভাষা আন্দোলন।


পাকিস্তানের গণতন্ত্রের অবস্থা


গণতান্ত্রিক পন্থায় পাকিস্তান কায়েম হওয়া সত্বেও সরকার অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে টিকে থাকার ষড়যন্ত্র করে।  আইয়ুব খান গণতন্ত্র হত্যা করার অভিনব উপায় আবিষ্কার করেন।  মৌলিক গণতন্ত্রের নামে জনগণকে সরকার গঠনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো।  কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থিত থাকায় এবং আসল ক্ষমতা আইয়ুব খানের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকায় পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।


ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র

উল্লেখযোগ্য কারণসমূহ স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি রচনা করলেও ১৯৭১ এর নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে ঘড়ি মসি এবং অবশেষে দমনমূলক কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণেই আন্দোলনের জন্ম দেয়।

একাত্তরে ভারত বিরোধী ও ইসলামপন্থীদের ভূমিকা


ভারত বিরোধী ও ইসলামপন্থীরা উভয় সংকটে পড়ে গেল।  যদিও তারা ইয়াহিয়া সরকারের সন্ত্রাসবাদি দমন-নীতিতে দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর মনে করতেন,  তবুও এর প্রকাশ্যে বিরোধিতা করার কোন সাধ্য তাদের ছিল না।  বিরোধীতা করতে হলে তাদের নেতৃস্থানীয়দের কেউ অন্যদের মতো ভারতে চলে যেতে হতো যা তাদের পক্ষে চিন্তা করা অসম্ভব ছিল।


স্বাধীনতার পেছনে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ভূমিকা


এ দুরবস্থার প্রধান কারণ এটাই ছিল যে,  পূর্ব বাংলাকে ব্রিটিশ আমলে কলকাতার প্রস্তাব ভূমি (হিন্দারল্যান্ড)  বানিয়ে রাখা হয়েছিল।  এখানকার চাউল, মাছ, মুরগি, ডিম, দুধ, পাট ও যাবতীয় কাঁচামাল কলকাতায় প্রয়োজন পূরণ করতো।  আর কলকাতার কারখানার উৎপন্ন দ্রব্য এখানকার বাজারে বিক্রি হত।  তদুপুরী শিক্ষা,  চাকরি,  ব্যবসা ইত্যাদি অমুসলিমদেরকেই কুক্ষিগত ছিল। ঢাকা নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ও আসামের মুসলমানরা নিজেদের এলাকায় ও এর অধিবাসীদের উন্নয়নের প্রয়োজনে ঢাকাকে রাজধানী করে একটি আলাদা প্রদেশ করার আন্দোলন চালায়,  যাতে কলকাতার শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে এই এলাকাটি উন্নতি করতে পারে।  এই দাবির যুক্তি কথা স্বীকার করে ইংরেজ সরকার  ১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম এলাকা নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করে। ১৯০৬  সালে এই নতুন প্রদেশই রাজধানী নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের জন্ম হয়।  এ সম্মেলনে গোটা ভারতবর্ষের বড় বড় মুসলিম নেতা যোগদান করায় ঢাকার গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়।


বঙ্গভঙ্গ বাতিল আন্দোলন


এই নতুন প্রদেশে মুসলমানদের প্রধান্য,  প্রভাব ও উন্নতির যে বিরাট সম্ভাবনা দেখা দিল,  তাতে কলকাতার তীব্র আঘাত লাগলো।  অমুসলিম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ,  শিল্পপতি ব্যবসায়ী উৎসব পদস্থ সরকারি কর্মচারী অন্যান্য পেশাজীবী “বাংলা মায়ের দ্বিখণ্ডিত” হওয়ার বিরুদ্ধে চরম মায়া কান্না জুড়ে দিলেন।  অখন্ড মায়ের দরদে তারা গোটা ভারতে তোলপাড় সৃষ্টি করলেন। এ আন্দোলনে ব্যারিস্টার আব্দুর রসুলের মত কিছু সংখ্যক মুসলিম নামধারী বুদ্ধিজীবী ও শরিক হয়ে অখণ্ড বাংলার দোহাই দিয়ে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ময়দানে নেমে পড়েন।  এ আন্দোলনের পরিণামে 1911 সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত হয়ে পূর্ব বাংলা আবার কলকাতার লেজুরে পরিণত হয়।  যদিও বঙ্গভঙ্গ রহিত না হতো,  তাহলে 1947 সালে ডাকাকে একটি উন্নত বৈদেশিক রাজধানী হিসেবে এবং চট্টগ্রামকে কোট হিসেবে রেডি পাওয়া যেত।  তাছাড়া শিক্ষাও চাকরিতে মুসলমানরা এগিয়ে যাবার সুযোগ এবং এলাকার শিল্প ও বাণিজ্য গড়ে উঠতো।


পূর্ব বাংলার উন্নয়ন


১৯৪৭ সালের পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবার পর এই পূর্ব বাংলার সার্বিক উন্নয়ন শুরু হয়। কেন্দ্রীয় প্রতিশ্রিক সিভিল সার্ভিস, পুলিশ সার্ভিস ইত্যাদিতে মুসলমান অফিসার নিয়োগ শুরু হলো।  অগণিত পদে মুসলিম যুবকরা ব্যাপকভাবে চাকরি পেতে লাগলো। অপরদিকে ব্যবসা বাণিজ্যের ময়দানে অমুসলিমদের স্থানে মুসলিমদের অগ্রযাত্রা শুরু হলো।  ভারত থেকে হিজরত করে আসা লোকেরাই অমুসলিম ব্যবসায়ীদের সাথে বিনিময়ের ভিত্তিতে দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করলো। শিল্প কারখানার পুঁজি এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে মুজাহের এলাকার উন্নয়নে লেগে গেল। যদি পাকিস্তান না হত এবং আমরা যদি অখন্ড ভারতের অন্তর্ভুক্তই থাকতাম,  তাহলে আজ স্বাধীন বাংলাদেশ নামে কোন রাষ্ট্রের জন্ম হতো না।  এ অবস্থায় এ এলাকার মুসলমানদের কি দশা হতো তা কি আমরা ভেবে দেখি?  আর যারা জেনারেল তাদের প্রয়োজনই নন কমিশন অফিসারের ওপর কোন স্থান দখল করার সুযোগ পেতেন?  সেক্রেটারি মর্যাদা নিয়ে যারা সচিবালয় কর্তিত্ব করছেন, তাদের কজন সেকশন অফিসারের উপরে উঠতে পারতেন?  আর যারা পুলিশের বড় কর্তা,  তারা দারোগার বেশি হতে পারতেন কি? প্রশ্ন রয়ে গেল আপনাদের কাছে?


সার্বিক উন্নয়ন হলো না কেন? 


এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে পূর্ববঙ্গের সার্বিক উন্নয়ন না হওয়ার জন্য পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান দায়ী।  ইংরেজ চলে যাবার পর প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে যারা কেন্দ্রীয় ও প্রদেশিক সরকার পরিচালনা করলেন,  তাদের মধ্যে পূর্ববঙ্গের কোন বড় কর্মকর্তা ছিল না।  আর পাকিস্তান আন্দোলনে যেসব নেতা কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন,  তাদের মধ্যেযারা পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন,  তারা এত অনভিজ্ঞ ও দুর্বল ছিলেন যে,  পূর্ববঙ্গের উন্নয়নের ব্যাপারে প্রথম থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের যতটা করণীয় ছিল তার সামান্য কিছুই আদায় করা সম্ভব হয়েছে। নিজেদের নায্য অধিকার আদায়ের যোগ্যতা না থাকলে এক মায়ের পেটের ভাইয়ের কাছেও ঠকতে হয়।  যে ভাই ঠকায় সে নিশ্চয়ই দোষী।  কিন্তু সে তার স্বার্থ যেমন বুঝে নিচ্ছে,  অপর ভাই যদি নিজের অধিকার আদায় করার যোগ্য হয়,  তাহলে আর ঠকতে হয় না।  আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল নিঃস্বার্থ,  জনদরদী,  সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব।  পূর্ব পাকিস্তানের ওপর যত অবিচার হয়েছে এর জন্য প্রধান দায়ী এখানকার ওইসব নেতা,  যারা কেন্দ্রীয় সরকারের শরীর থেকেও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেননি। বিশেষ করে আয়ুবের আমলে যারা মন্ত্রিত্ব ও ব্যক্তিগত স্বার্থ পেয়ে গণতন্ত্রের বদলে একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করেছিলেন।  নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের জন্য যারা শুধু লর্ড ক্লাইভ কে গালি দেয়,  তাদের সাথে একমত হতে পারি না।  ক্লাইভ তার জাতীয় স্বার্থের পক্ষে যোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।  মীর জাফরের স্বার্থপরতা ও বিশ্বাসঘাতকতারই ধরুন যে আমরা পরাধীন হয়েছিলাম,  তা থেকে শিক্ষা আজও আমরা নিচ্ছি না। পশ্চিম পাকিস্তানের ক্লাইভ এর চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মীরজাফরাই যে আমাদের অবনতির জন্য অধিকতর দায়ী সেই কথা কেউ উপলব্ধি করতে চায় না।


রাজনৈতিক মত পার্থক্য কি স্বাধীনতা বিরোধী


অভিযুক্ত ভারত থেকে ইংরেজ বিতরণের আন্দোলনে কংগ্রেসের সাথে মুসলিম লীগের মতবিরোধকে কিছু সংখ্যক কংগ্রেস নেতা স্বাধীনতা বিরোধী বলে প্রচার করতো।  কংগ্রেস হিন্দু মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাবি করত।  এবং গোটা ভারতকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছিল।  কিন্তু মুসলিম লীগ জানত যে কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনের ফলে ইংরেজদের গোলামী থেকে মুক্ত পেয়েও মুসলমানদেরকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের অধীন থাকতে হবে।  তাই ওই স্বাধীনতা দ্বারা মুসলমানদের মুক্তি আসবে না।  তাই মুসলিম লীগ পৃথকভাবে স্বাধীন আন্দোলন এবং ভারত বিভাগ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় পাকিস্তান দাবি করল।  ফলে মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলন কংগ্রেসের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেল। 

No comments

Powered by Blogger.